মো. নিজাম উদ্দিন, লক্ষ্মীপুর:
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জের বালুরটেক এলাকায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে স্থানীয় একটি বখাটে গ্রুপ। উঠতি বয়সী প্রায় অর্ধশতাধিক তরুণ-কিশোরকে নিয়ে গঠিত এ গ্রুপের নাম ‘বড়ভাই’ গ্রুপ। নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ওই এলাকার তরুণ আরমান (২০) হোসেন।
গ্রুপের সদস্যরা তাকে ‘বড়ভাই’ বলে ডাকে। তাই এ গ্যাংটি ‘বড়ভাই’ গ্রুপ নামে পরিচিত। এলাকার অন্য কিশোর বা তরুণদের গ্রুপের প্রধান আরমানকে ‘বড়ভাই’ হিসেবে ডাকতে হয়। তা না হলে হামলা এবং নির্যাতন করা হয় তাকে।
এলাকার বৃদ্ধ থেকে শুরু করে যুবকরা এ গ্রুপের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। তাই ‘বড়ভাই’ গ্রুপকে নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয়রা।
প্রতিবাদ জানিয়ে গত শুক্রবার (৪ নভেম্বর) বিকেলে শতাধিক লোকজন তার বিরুদ্ধে ভবানীগঞ্জের বালুরটেক এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করে।
‘বড়ভাই’ খ্যাত আরমান হোসেনকে নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে তার খোঁজে মাঠে নামে পুলিশ।
রোববার (৬ নভেম্বর) দুপুরে জেলা পুলিশ সুপার মাহফুজ্জামান আশরাফ ও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মোসলেহ উদ্দিনসহ বিপুল পরিমাণ পুলিশ সদস্য ভবানীগঞ্জের বালুরটেক এলাকায় যান। সেখানে স্থানীয় লোকজন ও অভিযুক্ত আরমানের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ। বাড়ির সামনে থাকা আরমানের আস্তানাও পুলিশ দেখে যায়।
সেখানে গ্যাংয়ের সদস্যদের ধরতে অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযানে হাসান নামে এই গ্রুপের এক সদস্যকে আটক করা হয়।
এদিকে পুলিশ সুপার মাহফুজ্জামান আশরাফ স্থানীয় লোকজনকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘বড়ভাই’ গ্রুপসহ সব কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।
এসময় এসপি সাংবাদিকদের বলেন, ২০ বছরের এক তরুণ আরমান, বালুর টেক এলাকায় ‘টিকটকের মাধ্যমে একটি গ্যাং তৈরি করেছে। নাম দিয়েছে ‘বড়ভাই’। সে একটা ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করতে চায়। গ্যাং দিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়। এটাকে দমন করার জন্য আমি নিজেই ঘটনাস্থলে আসি। তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলি। পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই বললেই চলে। আমরা এ গ্যাংকে দমন করবোই। যেখানেই কিশোর গ্যাং বা এ ধরনের কোনো বাহিনী মাথাছাড়া দেওয়ার চেষ্টা করবে, সেখানেই তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।
‘বড়ভাই’ খ্যাত আরমান হোসেন ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চরমনসা গ্রামের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাদিরের ব্রিজ সংলগ্ন বাসিন্দা জহির উদ্দিনের ছেলে। তার বিরুদ্ধে মাদক সেবন, চাঁদাদাবি, প্রতিপক্ষের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগ করেছে এলাকাবাসী। তার অন্যতম সহযোগী হলো- সাগর, রাব্বি, ফারুক ও রাকিব।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি স্থানীয় কালাম নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ তুলে তার কাছে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। স্থানীয় শরীফ ও মোহন নামে দুই ভাই বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় তাদের হাতে হামলার শিকার হতে হয়েছে। তারা এখন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
আহতরা হলেন, ভবানীগঞ্জের চরমনসা গ্রামের খাঁ বাড়ির শাহ আলম খাঁর ছেলে মো. শরীফ উদ্দিন (২৫) ও মোহন (৩০)।
হামলার সময় তারা নুর হোসেনের টেলিকম নামে একটি দোকানে আশ্রয় নেন। সেখানেও হামলা চালিয়ে দোকানে থাকা নগদ টাকা লুটে নেয় হামলাকারীরা। এ ঘটনায় আরমান ওরফে বড়ভাইকে প্রধান করে ১১ জনের বিরুদ্ধে সদর থানায় মামলা দায়ের করে আহতদের ভাই নুরুল আলম (৪৫)।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. রিপন খাঁ বলেন, কিশোর গ্যাং ‘বড়ভাই’ গ্রুপের প্রধান হলেন আরমান হোসেন। মোবাইলে মেসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে মুহূর্তেই গ্রুপের সদস্যরা একত্র হয়ে যায়। আরমানদের বাড়ির সামনে একটি বৈঠকখানা আছে। সেখানেই সবাই মিলে একত্র হয় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নামে। এলাকায় বিভিন্ন বাড়িতে মোবাইল ফোনসহ মূল্যবাল মালামাল চুরি হচ্ছে। এ গ্রুপের সদস্যরা চুরির ঘটনার সঙ্গেও জড়িত। সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে চাঁদা আদায় করে। দাবিকৃত চাঁদা না দিলে নির্যাতন করে। বিয়ে বাড়িতেও হামলা চালিয়েছে এ গ্রুপের সদস্যরা।
তিনি বলেন, বড়ভাই গ্রুপের অত্যাচারে আমরা এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। ভয়ে মুখ খুলতে পারতাম না, কখন কার ওপর হামলা হয়। কিন্তু এখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তাই অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নেমেছি।
স্থানীয় সবুজ মাঝি বলেন, বিগত ৪ মাস আগে আরমানসহ ৪/৫ জন তাদের বাড়িতে যায়। এ সময় তার ভাই আবুল বাশারের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিল। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা বিয়ে বাড়িতে হামলা চালায়। পরে পুলিশে খবর দিলে তাদের থানায় নিয়ে যায়। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ দায়ের করা আছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আমির হোসেন, আবুল কালাম, মো. আলী হোসেন, আবদুস শহীদ, পারভেজ, ফারুক, নুর আলম, রিনা আক্তার, আফিয়া খাতুন ও মুরশিদাসহ অনেকে বলেন, ‘বড়ভাই’ গ্রুপের সদস্যরা দোকানে বসে আড্ডা জমায়। এলাকায় গণ্যমান্য কাউকে পরোয়া করে না। বয়স্কদেরই তাদের মান্য করে চলতে হয়। তারা মাদক সেবন করে, কিন্তু তাদের সামনে কেউ ধুমপান করলে তাকে অপদস্ত হতে হয়। ধুমপান করাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি এক যুবককে বেধড়ক মারধর করেছে আরমান ওরফে বড়ভাই। এ গ্রুপটি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পর এলাকায় চুরির ঘটনাও বেড়ে গেছে।