শিরোনাম

পর্যটন সম্ভাবনাময় হাতিয়ার নিঝুমদ্বীপ

মো. বুলবুল আলম:

নিঝুম দ্বীপ বাংলাদেশের একটি ছোট্ট দ্বীপ। এটি নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার অন্তর্গত। ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার পুরো দ্বীপটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। এ দ্বীপের মাটি চিকচিকে বালুকাময়, তাই জেলেরা নিজ থেকে নামকরণ করে বালুর চর। নোনাপানিবেষ্টিত নিঝুম দ্বীপ কেওড়া গাছের অভয়ারণ্য। ম্যানগ্রোভ বনের মধ্যে সুন্দরবনের পরে নিঝুম দ্বীপকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন বলে অনেকে দাবি করেন। বঙ্গোপসাগরের বুকে মেঘনার মোহনায় জেগে ওঠা এই নিঝুম দ্বীপে ১৯৪০-এর দশকে এখানে মানুষের পদার্পণ শুরু হয়। মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী আমিরুল ইসলাম কালাম দ্বীপটি দেখতে এসে এর স্নিগ্ধময় অপরূপ সৌন্দর্য ও শান্তশিষ্টতা দেখে মুগ্ধ হয়ে এই দ্বীপের নাম দেন ‘নিঝুম দ্বীপ’। নিঝুম দ্বীপে দাঁড়িয়ে মনে হবে এই দ্বীপ আসলেই নিঝুম, যেন বাংলাদেশ ছেড়ে, পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোনো এক স্বপ্নভূমি অবলোকন করছি।

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত এই দ্বীপ অবারিত সবুজ, বৈচিত্র্যময় অদ্ভুত প্রাণচাঞ্চল্যের দ্বীপ। একদিকে ম্যানগ্রোভ বন ও অন্যদিকে বিস্তীর্ণ বালুরাশির এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা বৈচিত্র্যময়, অন্যদিকে পর্যটনের জন্য বড় একটি সম্ভাবনাময় জায়গা এই দ্বীপ। সময়ের সঙ্গে বাড়তে বাড়তে আজ বিশাল এক ভূখন্ডে পরিণত হয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা এসব চর বাংলাদেশের মানচিত্রে বেশ ভালোই প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা যায়। এই দ্বীপের সূর্যাস্ত এতই মোহনীয় যে, কিছুক্ষণের জন্য আপনার মনে হবে আশপাশের জগৎ স্তব্ধ হয়ে গেছে। প্রকৃতির এমন সান্নিধ্যে খেই হারিয়ে ফেলাটাও একেবারে ভিন্ন রকম অনুভূতি। এ ছাড়াও আছে নামার বাজার সিবিচ। ম্যানগ্রোভ বনের ভেতরে ঘুরতে যাওয়া যায় দিনের বেলায়। এ ছাড়াও রাতের বেলা আশপাশের পুরো এলাকা ঘুরে দেখা যায় হেঁটে হেঁটে। রাতের বেলায় আকাশে তারার যে মেলা বসে, এ রকম অসম্ভব সৌন্দর্য দেশের খুব কম জায়গায়ই আছে। শ্বাসমূলের বন, প্রমত্ত মেঘনার বুক চিরে যাত্রা, বনের ভেতর ভোরের মোহনীয় সৌন্দর্য, আচমকা ছুটে যাওয়া চিত্রা হরিণ, সমুদ্র বালুবেলা, গহিন রাতের খোলা প্রান্তরে তারার হাতছানি, নিঝুম এক পরিবেশে এক অনন্য প্রকৃতি অবলোকন, এসব মিলেই নিঝুম দ্বীপ। যেকোনো জায়গার চেয়ে রহস্যময়, ভ্রমণপিপাসুদের রোমাঞ্চ দেয় এটি। যেকোনো ভ্রমণপিপাসুর জন্য অবশ্য দর্শনীয় স্থান এই বিচ্ছিন্ন, রহস্যময়, রূপসী দ্বীপ। শীতকালে নিঝুম দ্বীপে সরালি, জিরিয়া, লেনজা, পিয়ং, রাঙ্গামুড়ি, চখাচখি, ভূতিহাঁস, রাজহাঁস, কাদাখোঁচা, বাটান, জিরিয়া, গুলিন্দা, গাঙচিল, কাস্তেচরা, পেলিক্যান ইত্যাদি হাজারো অতিথি পাখির আগমন ঘটে। স্থানীয় পাখির মধ্যে চোখে পড়ে সামুদ্রিক ঈগল, বক শঙ্খচিল। এ ছাড়া দ্বীপে রয়েছে হরিণ, বন্য শূকর, শেয়াল, বানর এবং নানা রকম সাপ। নিঝুম দ্বীপের মতো দেশের অন্য কোথাও একসঙ্গে এত চিত্রা হরিণ দেখা যায় না। নিঝুম দ্বীপে দেখা মিলে প্রায় ৩৫ প্রজাতির বিভিন্ন পাখির। মেঘনা নদী আর বঙ্গোপসাগরের মোহনায় দেশের দক্ষিণে অপরূপ সৌন্দর্যের দ্বীপ নিঝুম দ্বীপ। ছোট্ট আয়তনের এ দ্বীপটির নয়নাভিরাম দৃশ্য কঠিন হৃদয়কেও সবুজের প্রেমে আকৃষ্ট করে। অজান্তেই মনের ভেতর চলে আসে গান। পাখির ডাক, নদীর ঢেউ, সারি সারি কেওড়া গাছ, সূর্যাস্তের দৃশ্য আর মায়াবী হরিণের পদচারণা। রাতের বেলা জোছনার আলো ঢেউয়ের সঙ্গে মিতালী পাতে। নিঝুম দ্বীপ সত্যিই নিঝুম, নিশ্চুপ। তাই এখান থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্বও আয় করা সম্ভব।

ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতিদিন লঞ্চ হাতিয়ার উদ্দেশে ছাড়ে। চট্টগ্রামের সদরঘাট থেকেও একটি জাহাজ হাতিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। নিঝুম দ্বীপে পর্যটকদের থাকার জন্য অবকাশ পর্যটন নির্মাণ করেছে নিঝুম রিসোর্ট। এ ছাড়াও আরো কয়েকটি রেস্ট হাউস রয়েছে। পর্যটন আর অর্থনীতিতে সম্ভাবনাময় স্থান নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া। এই হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ একটি নান্দনিক স্থান। নিঝুম দ্বীপের সমুদ্রসৈকত দ্বিতীয় কক্সবাজার। বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি উপকূলীয় দ্বীপ হাতিয়া। চারদিকে অথৈজলের রাশি আর উত্তাল তরঙ্গের মাঝে যেন ভাসমান ভেলা। নিঝুম দ্বীপ হাতিয়ার অলঙ্কার। নিঝুম দ্বীপসহ জেগে ওঠা চরাঞ্চল নিয়ে গড়ে উঠতে পারে সম্ভাবনার আরেক নতুন বাংলাদেশ। নিঝুম দ্বীপের দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে রয়েছে বনবিভাগের তৈরি বাগান। সেখানে সুন্দরী, কেওড়া, গেওয়া, গোলপাতা, কেশরী ইত্যাদি বৃক্ষ জন্মে। অপরূপ নৈসর্গিক শোভামন্ডিত নিঝুম দ্বীপ। এ দ্বীপের লোকসংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার হলেও চিত্রল হরিণের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। নিঝুম দ্বীপ বাংলাদেশের এক মাত্র দ্বীপ, যে দ্বীপে মানুষের চেয়ে হরিণ বেশি। দ্বীপের বনে, ফসলের মাঠে, রাস্তাঘাটের পাশাপাশি লোকালয়েও ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়ায় হরিণের পাল। নিঝুম দ্বীপে বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে পলিমাটির চর; যা জোয়ারের পানিতে ডোবে এবং ভাটায় শুকিয়ে যায়। বর্ষা মৌসুমে ইলিশের জন্য নিঝুম দ্বীপ বিখ্যাত। এ ছাড়া শীত কিংবা শীত-পরবর্তী মৌসুমে নিঝুম দ্বীপ চেউয়ামাছের জন্য বিখ্যাত। জেলেরা এ মাছ ধরে শুঁটকি তৈরি করেন। কয়েকভাবে নিঝুম দ্বীপে যাওয়া যায়। ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে হাতিয়া। হাতিয়া থেকে বোট বা ট্রলারে নিঝুম দ্বীপ। এ ছাড়া বাসে নোয়াখালীর সোনাপুর যেতে হয়। সোনাপুর থেকে সুবর্ণচর হয়ে দ্বীপ হাতিয়া, তারপর প্রকৃতির লীলাভূমি নিঝুম দ্বীপ।

উত্তাল সাগরের কোলে সবুজ প্রকৃতির এক মায়াবী ভূখন্ড নিঝুম দ্বীপ। দ্বীপের সৈকতে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত, চিত্রল হরিণের ছোটাছুটি আর কেওড়া, বাইন, গেওয়া বনসহ সবই আছে দ্বীপটিতে। নিঝুম দ্বীপ ও হাতিয়াকে নিয়ে পর্যটন আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু বানাতে বিশাল পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। দেশি পর্যটকদের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকরাও যেন ছুটে যান হাতিয়া হয়ে নিঝুম দ্বীপে, সেজন্য সরকার দ্বীপ দুটি ঘিরে ইকো-ফ্রেন্ডলি (ঐতিহ্য-প্রকৃতির সংরক্ষণ ও উন্নয়নের উদ্দেশ্যে স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে) পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে।

বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের গৃহীত এক প্রকল্পের আওতায় দ্বীপ দুটি ঘিরে পর্যটকদের জন্য মানসম্মত যোগাযোগব্যবস্থা ও অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। পর্যটনের যাবতীয় সুবিধা, তথা ক্যাটারিং, পিকনিক শেড, কিডস কর্নার, বিনোদন পার্ক, ইয়ুথ ইন, কনফারেন্স হল, ওয়াচ টাওয়ার, কৃত্রিম লেক, রিভার ক্রুজ পরিচালনার জন্য ক্রুজ ভ্যাসেল, বারবিকিউ শেড, সার্ভিস ব্লক ইত্যাদি থাকবে এই দুই দ্বীপে। পুরো এলাকায় জোরদার করা হবে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাও। ৪৮ কোটি ৭৭ লাখ ৬৬ হাজার টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে চলতি ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। নিঝুম দ্বীপ ঘুরে যেন পর্যটকেরা হাতিয়ায় উন্নত পরিবেশে থাকতে পারেন, খেতে পারেন, সে ব্যবস্থা করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে হাতিয়া-নিঝুম দ্বীপে পর্যটক বাড়বে কয়েক গুণ। মেঘনার শেষ প্রান্তে ফেনিল ঢেউয়ের মধ্যে ভাসমান হাতিয়া-নিঝুম দ্বীপের নিরিবিলি পরিবেশ পর্যটকদের হাতছানি দেবে বারবার। এ অঞ্চলে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদের সুবিধার্থে সেখানে রেস্তোরাঁ, কটেজ ও ক্রুজ ভেসেল সংগ্রহে প্রায় ৫০ কোটি টাকার আরো একটি প্রকল্প নিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে ওই প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়েছে।

নিঝুম দ্বীপের একদিকে মেঘনা নদী আর তিন দিকে বঙ্গোপসাগর ঘিরে নিঝুম দ্বীপের বর্তমান আয়তন প্রায় ৯২ বর্গকিলোমিটার। এর উত্তর অংশে রয়েছে বন্দরটিলা। দ্বীপের ৭০ ভাগ মানুষ মৎস্যজীবী ও ৩০ ভাগ কৃষিজীবী। গভীর সমুদ্র ও নদীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বসবাসকারীরা থাকে আতঙ্কিত। তবু জীবিকার টানে তাদের গভীর সমুদ্রে পাড়ি জমাতে হয়। নিঝুম দ্বীপে খালগুলোর মধ্যে চৌধুরীর খাল, পটকাখালী খাল, সোয়ানখালী খাল, ডুবাই খাল, ধামসাখালী খাল, ভট্রোখালী খাল, কাউনিয়া খাল, লেংটা খাল। সন্ধ্যায় কবিরাজের চরে সূর্যাস্তের সঙ্গে হাজার হাজার মহিষের পাল দৃষ্টি কাড়বে। আর কমলার দ্বীপে কমলার খালে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যায়। নিঝুম দ্বীপে পর্যটনের আবাসিক ব্যবস্থা ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি উন্নত মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে, বেশির ভাগ হোটেল নামার বাজার এলাকায়। এ ছাড়া রয়েছে জেলা পরিষদ ডাকবাংলো বন বিভাগের ডাকবাংলো।

লেখক : বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) কর্মকর্তা, সিইডিপি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়

Share now

আরও পড়ুন